রাতের অন্ধকার নামতেই রাজধানীর রাজপথ থেকে অলিগলি-বেপরোয়া হয়ে ওঠে অপরাধচক্র। তাদের নানা অপতৎপরতায় রীতিমতো ভীতিকর ও অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েন নাগরিকরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ, দখলবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা তুচ্ছ ঘটনায় ঘটছে রক্তারক্তি। এছাড়া পুলিশি তৎপরতা কম থাকায় ঘটছে ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। প্রায় প্রতি রাতেই কিশোর গ্যাং, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুসারী এবং ছিনতাইকারীদের হামলার শিকার হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।
ড. মালেকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অনার্সের ছাত্র রিফাত হাওলাদার (২০)। তার বাসা হাজারীবাগের রায়ের বাজার এলাকায়। শুক্রবার রাত ১০টার দিকে এক বন্ধুর সঙ্গে বাসা থেকে বের হন রিফাত। কিছুদূর যেতেই তাদের ঘিরে ধরে একদল যুবক। সঙ্গে থাকা বন্ধু ভয়ে পালিয়ে যান। তবে রিফাত এই দুর্বৃত্তদের কবল থেকে রেহাই পাননি। এরা রিফাতকে শাসানোর একপর্যায়ে তার পেটে ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে রাস্তায় ফেলে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে পথচারীরা তাকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যান। রিফাতের মামা সোহেল যুগান্তরকে জানান, ওই দুর্বৃত্তরা কিশোর গ্যাং গরু সোহেলের সহযোগী। শুধু রিফাতই নন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালে আসছেন অনেক ভুক্তভোগী। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টা থেকে শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চিকিৎসা নিতে আসেন ৪১০ জন রোগী। তাদের মধ্যে ১৫০ জনকে ভর্তি করা হয় এই হাসপাতালে। এর মধ্যে শুক্রবার রাত ৮টার পর থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত অন্তত ৭০ জন রোগী ছুরিকাহত কিংবা আহত হয়ে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হামলা, দুর্বৃত্তদের হামলা এবং দখল কিংবা আধিপত্য নিয়ে মারামারিতে আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন এদের বেশির ভাগ রোগী।
জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ৮০টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। গ্যাংগুলো আগে নিয়ন্ত্রণ করত আওয়ামী লীগদলীয় বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি। এখন গ্যাংয়ের সদস্যরা ভোল পালটিয়ে বড় ভাই মানতে শুরু করেছে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের স্থানীয় নামধারী নেতাদের। নতুন করে শুরু করেছে এলাকায় দখল, চাঁদাবাজি, হানাহানি, মাদক ব্যবসাসহ নানা ধরনের নৈরাজ্য।
শুক্রবার রাত ৯টার দিকে যাত্রাবাড়ীর জনপথ মোড়ে ডিউটিরত অবস্থায় ট্রাফিক পুলিশ সদস্য আশরাফ আলীকে পিঠে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় দুই দুর্বৃত্ত। গুরুতর অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মো. ফারুক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ঘটনাস্থলে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরাও নেই এখন। যে কারণে দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় আনার। পুলিশের অপর একটি সূত্র জানায়, ট্রাফিক পুলিশকে আতঙ্কিত করতেই হয়তো কনস্টেবল আশরাফ আলীকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। তাছাড়া ট্রাফিক পুলিশ ইতোমধ্যে সড়কে মামলা নেওয়া শুরু করেছে। হয়তো কেউ এই কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে এ হামলা করে থাকতে পারে। একাধিক বিষয় সামনে রেখে তদন্ত কাজ চলছে।
একই রাতে মুগদা থানাধীন মান্ডা কাজীবাড়ি মসজিদের পাশে আশিকের দোকানের কর্মচারী খোকনের সঙ্গে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে স্থানীয় ৬-৭ যুবকের হাতাহাতি হয়। এসময় আশিক ও তার ভাইয়েরা এগিয়ে গেলে কসাইখানার চাপাতি নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায় ওই যুবকেরা। তাদের মারধরে আশিক ঘটনাস্থলেই মারা যান। আর গুরুতর আহত হন তার দুই সুজন ও সামস এবং কর্মচারী খোকন আহত হয়। মুগদা থানার এসআই মুবাদুল ইসলাম জানান, এ ব্যাপারে মামলা হয়েছে। হত্যাকাণ্ড ও হামলায় জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
বনশ্রী কাঁচাবাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে গত কয়েক দিন যাবত বিএনপিদলীয় একাধিক গ্রুপের মধ্যে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছিল। শুক্রবার রাত ১০টার দিকে দুপক্ষের মধ্যে মারামারিতে অন্তত চারজন আহত হয়। রামপুরা থানার পরিদর্শক তদন্ত শাহাদাত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বনশ্রী কাঁচাবাজারের এক পানির ব্যবসায়ী থানায় এসে অভিযোগ করেন, তার এক কর্মচারীকে প্রতিপক্ষের লোকজন আটক করে রেখেছে। সেখানে আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোর্স পাঠাই।
কিন্তু পুলিশ গিয়ে এ ধরনের কোনো জিম্মি করার ঘটনা পায়নি। এরপর পুলিশের সামনেই দুগ্রুপ মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশ সাধ্যমতো চেষ্টা করে আহত চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়।
শুধু এসব ঘটনাই নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার কারণে প্রতি রাতেই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় হামলা, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের হামলার ঘটনায় আতঙ্ক বাড়ছে জনমনে। এদিকে জামিনে মুক্তি পেয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন কয়েক শীর্ষ অপরাধী। এর পরই অপরাধ জগতে উত্তেজনা বাড়ছে। যদিও পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, তাদের বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছে।
তবে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, জামিনে বের হওয়া অনেকের বিরুদ্ধেই কারাগারে থেকেও তৎপরতা চালানোর অভিযোগ ছিল। এখন তারা মুক্ত। তাদের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে সাধারণ মানুষের স্বস্তিতে জীবনযাপন কঠিন হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের নিয়মিত পুলিশিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগে পুলিশি কার্যক্রম যেভাবে পরিচালিত হতো বর্তমানে সাপোর্ট কম রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় অনেক যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে যা আছে, তার সর্বোত্তম ব্যবহার করার চেষ্টা করছি পুলিশি সেবা পৌঁছে দিতে। তিনি বলেন, এর ব্যাপ্তি বাড়বে দিন দিন। আশা করি অচিরেই আমরা সুশৃঙ্খল পরিবেশ উপহার দিতে পারব নগরবাসীকে।